Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
চাকরি খোঁজা নয়, উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা

‘এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়।’

দেশে কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এ মন্তব্য করেন, সেই বাস্তবতার সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের পার্থক্য অনেক।

তখন উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তার ঘাটতি ছিল। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল চাকরি। এখন প্রেক্ষাপট বদলেছে। দেশের যে ৫ কোটি ৩০ লাখ তরুণ জনগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন, তাদের কাছে চাকরি একমাত্র বিকল্প নয়।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের অন্যতম অঙ্গীকার ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’। সরকারের নানামুখী উন্নয়ন তৎপরতার ওপর দাঁড়িয়ে সে লক্ষ্যে হাঁটা শুরু করেছে দেশ।

এখন এই বিপুলসংখ্যক তরুণের অনেকেই চাকরির খোঁজার পরিবর্তে নিজের দক্ষতা, যোগ্যতা ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাচ্ছেন। নিজেই নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করছেন তারা। পাশাপাশি অসংখ্য বেকারের চাকরিরও সংস্থান করছেন। কর্মমুখী শিক্ষাও রপ্ত করেছেন অনেকে, যা বেসরকারি বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে তাদের ভালো মানের চাকরি পেতে কাজে লাগছে।

এ ছাড়া বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে চাকচিক্যময় শো-রুম খুলে ব্যবসার ধারণাতেও এসেছে পরিবর্তন। তরুণ উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করছেন। ওয়েবসাইটে খুলে বসেছেন বিচিত্র পণ্যের পসরা। গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ডেলিভারিম্যানের। কর্মসংস্থানে দেশে এটিও একটি নতুন ধারণা ও বিপুল সম্ভাবনার নাম।

আত্ম-কর্মসংস্থানে আরেকটি নতুন ধারণা যুক্ত হয়েছে মোটর সাইকেল বা মোটরগাড়িতে রাইডশেয়ারিং। এ খাতে সারা দেশে কয়েক লাখ কর্মসংস্থান এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। আউটসোর্সিংয়ে ৬ লাখের বেশি দক্ষ আইটি ফ্রিল্যান্সারের আত্ম-কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে দেশে।

উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে ডেইরি, পোল্ট্রি, কৃষি, নার্সারি, মোবাইল সার্ভিসিং, ব্লক, বাটিক, স্ক্রিন প্রিন্টিং, ফ্যাশন ডিজাইনিং, ক্যাটারিং, বিউটিফিকেশন, গৃহসজ্জা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ওয়েল্ডিং, ফটোগ্রাফি, সোলার প্যানেল স্থাপনসহ বিভিন্ন খাতে।

অর্থাৎ তরুণদের মধ্যে এখন চাকরি করার বদ্ধমূল ধারণায় পরিবর্তন এসেছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৬০ শতাংশ চাকরিজীবী কাজ করেন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৪ শতাংশ।

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েক হাজার সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা বেড়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে তা প্রায় ২০ লাখে দাঁড়ায়, তবে কর্মসংস্থান বিবেচনায় সরকারি খাতের অবদান ৪ শতাংশের কম। অথচ বছরে প্রায় ২০ লাখ তরুণ নতুন করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে।

এদের অনেকেই সরকারি চাকরি খোঁজার পেছনে এখন আর বছরের পর বছর সময় নষ্ট করতে রাজি নন। তারা হয় নিজেরাই উদ্যোক্তা হচ্ছেন অথবা স্বনির্ভর কোনো কাজে যুক্ত হচ্ছেন। বাকিরা বেসরকারি খাত কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান যোগ দিচ্ছেন।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৃহৎ, কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৩ হাজার। এগুলোর মালিকদের ৯৯ শতাংশই উদ্যোক্তা।

অন্যদিকে দেশে বেসরকারি খাতে এখন প্রায় ৫ কোটি মানুষ কাজ করছে। ছোট-বড় ব্যবসায়ী সৃষ্টি হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি।

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যক্তি মালিকানার কিংবা বেসরকারি খাতের এই উত্থানের বড় শক্তি ছিল দেশের যুব সমাজের চাকরিপ্রার্থী না হয়ে চাকরিদাতা হওয়ার মনোভাব। আজকের অর্থনীতিতে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

বাড়ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে যোগ হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এসব উদ্যোক্তার সংখ্যাগরিষ্ঠই তরুণ বা যুবশ্রেণি। তাদের অনেকেই বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্বপ্নের কথা বলছেন খোলামেলা। তাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, তারা চাকরিপ্রার্থী হতে চান না; উদ্যোক্তা হতে চান। তারা চান অন্যকে চাকরি দিতে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আসলে উদ্যোক্তা হওয়ার মতো সেই মেধা, উৎকর্ষ, প্রশিক্ষণ এবং ঝুঁকি নেয়ার অদম্য সাহস তাদের ছিল বলেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে বেসরকারি খাতের আজকের এ অবস্থানে আসা সম্ভব হয়েছে।

‘তবে তরুণ উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক এবং সম্ভাবনময় শ্রেণিকে বাধাহীন এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি এবং তাদের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। এ জন্য সরকারসহ খাত সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনগুলোকেও নীতিগতভাবে বিভিন্ন সুবিধা তৈরি করে দিতে হবে।’

ঢাকা চেম্বার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির একটি প্রকল্প নিয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তুলছে। একই সঙ্গে এসএমই ফাউন্ডেশন থেকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারাও প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করছে।

উদ্যোগী নারীদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে জয়ীতা ফাউন্ডেশন। উইমেন চেম্বার থেকেও নারী উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাইডাস থেকেও ছোট উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহায়তা দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন কর্ম সৃজন প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ এলাকায় ছোট ছোট উদ্যোক্তা গড়ে তুলছে।

এ ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় পাহাড়ি এলাকায় ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়ে তাদের বিকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও তাদের ঋণ সহায়তা দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিলও গঠন করেছে।

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘যুব উদ্যোক্তাদের জন্য যদি যুব ব্যাংক বা অন্য কোনো বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে স্বল্প সুদে নমনীয় শর্তে ঋণ দেয়া হয় এবং সাফল্য বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে ওই ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হয়, তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে লাখ লাখ উদ্যোক্তা তৈরি হবে।’

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার তাগিদে জীবনমুখী কর্মসংস্থানের জন্যই তরুণদের মধ্যে তাদের ভবিষ্যত নির্মাণের ভাবনায় একটা বদ্ধমূল পরিবর্তন এসেছে। এটা যতটা না পারিবারিক, তার চেয়ে বেশি তারুণ্যনির্ভর ও প্রযুক্তিসই মানসিকতা ধারণ করার কারণে।’

তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের সবার উচিত এ যুব প্রজন্মকে অর্থনৈতিক কার্যকর ধারায় সম্পৃক্ত করা। অর্থাৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টার চেয়ে উদ্যোক্তা তৈরির চেষ্টাই অর্থনীতিতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। এ লক্ষ্যে অব্যাহতভাবে নানামুখী উদ্যোগে যুবকদের সম্পৃক্ত করার এখনই সময়।’

দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করছে জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘এর পাশাপাশি বেকার যুব সমাজের জন্যও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত।’

তিনি বলেন, ‘এ খাতের উন্নয়নে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে এসএমই ফাউন্ডেশন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সারা দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পণ্য উৎপাদন, বাজার সংযোগ সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে তারা। এসব উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য আজ সারা বিশ্বে রপ্তানি হচ্ছে। করোনার মধ্যেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও গ্রামে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের তরুণ ও যুব সমাজ এখন চাকরি খুঁজছে না, নিজেরাই চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা করছে। আগে বলা হতো লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। এর বদলে এখন বলতে হয় উদ্যোক্তা হয় যে, গাড়ি-ঘোড়া বানায় সে।’

আইসিটি খাতে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ লক্ষাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন জানান, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এদের থেকে ২২ লাখ ৮০ হাজার ১৫৩ জন আত্মকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তারা যাতে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠতে পারেন, সে জন্য যুব ঋণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এ ছাড়া যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম যুব পাইকারি সেল ডটকম যুবাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারজাত করতেও ভূমিকা রাখছে।

Collection From newsbangla24



Do you Need Any Help?